মুহতারাম,
এশার সালাতের ওয়াক্ত শুরু হয় শাফাক অন্তর্হিত হলে। তো যাঁরা শাফাক অর্থ গ্রহণ করেছেন লালিমা তাঁদের মতে সূর্যাস্তের পর যখন সূর্যের লালিমা অন্তর্হিত হবে তখন থেকে এশার সালাতের ওয়াক্ত শুরু হবে। আর যাঁরা শাফাক অর্থ গ্রহণ করেছেন সাদা রেখা তাঁদের মতে লালিমার পরে দৃশ্য সাদা রেখাও যখন অন্তর্হিত হবে তখন এশার সালাতের ওয়াক্ত শুরু হবে। এই অনুচ্ছেদে আমাদের আলোচ্য লেখক এশার সালাতের ওয়াক্ত কখন শেষ হয় সেই আলোচনাকেই প্রাধান্য দান করেছেন। এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য হল, সকল মারফূ হাদীস এবং আছারে সাহাবাকে একত্রিত করলে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয় যে, এশার সালাতের ওয়াক্ত তিনভাগে বিভক্ত। এক: শাফাক অন্তর্হিত হওয়ার পর থেকে রাতের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত। আর এই এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত বিলম্বিত করে আদায় করা সর্বোত্তম। দুই: এক তৃতীয়াংশ হতে মধ্যরাত পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত। তবে মধ্যরাত পর্যন্ত বিলম্বিত করে আদায় করা ফযীলতের দিক দিয়ে প্রথমটির তুলনায় নিম্ন পর্যায়ের। তিন: মধ্যরাতের পর থেকে সুবহে সাদিক উদিত হওয়া পর্যন্ত। বিনা ওযরে এই সময়ে এশার সালাত আদায় করাটা মন্দকর্ম অথবা মাকরূহ। তবে এটি মন্দ হলেও এই সময়ে সালাত আদায় করলে তার সালাত ‘আদা’ হিসাবেই গণ্য হবে ‘কাযা’ হিসাবে নয়। কারণ, এশার সালাতের ওয়াক্ত অবশিষ্ট থাকে সুবহে সাদিক উদিত হওয়া পর্যন্ত। এবার আসা যাক লেখকের লেখা ও তা নিয়ে পর্যালোচনার পর্বে।
লেখক লিখেছেন, ‘এশার ছালাতের সময় সম্পর্কেও কিছু জাল ও যঈফ হাদীস প্রচলিত আছে।’ এরপর তিনি লিখেছেন, ‘আবু হুরায়াহ (রাঃ) বলেন, এশার ছালাতের শেষ সময় হল ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত। তাহক্বীক: যাকরিয়া বিন গোলাম কাদের এবং শায়খ আলবানী বলেন, এর কোন ভিত্তি নেই। ‘হেদায়া’র ভাষ্যকার আল্লামা ইবনুল হুমাম বলেন, ছালাতের ওয়াক্ত সংক্রান্ত হাদীছের মধ্যে কোথাও এটা পাওয়া যায় না। আল্লামা যায়লাঈ বলেন, গরীব বা ভিত্তিহীন। ইবনু হাজার আসক্বালানীও অনুরূপ বলেছেন। কিন্তু ইমাম তাহাবী মাযহাবী মোহে এর পক্ষে মত দিয়েছেন যা কাম্য নয়।’
আমার বক্তব্য
লেখক বহু জায়গায় পাঠককে সতর্ক করেছেন এই বলে যে, তাঁরা আল্লাহর নিকট কী জবাব দেবেন যদি তাঁরা সহীহ হাদীস অনুযায়ী আমল না করেন? কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, আল্লাহর নিকট তিনি কী জবাব দেবেন যখন আল্লাহ তাআলা তাঁর কাছে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়ার কৈফিয়ত তলব করবেন। তা-ও আবার শরীয়তের বিধি বিধান সম্পর্কিত বিষয়ে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়ার কৈফিয়ত?
আবু হুরায়রা রা.-এর যে বক্তব্য লেখক এখানে উল্লেখ করেছেন অর্থাৎ এশার সালাতের ওয়াক্ত সুবহে সাদিক পর্যন্ত থাকে-এটা না জাল, না ভিত্তিহীন আর না যঈফ। বরং বক্তব্যটি আবু হুরায়রা রা. থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত। পাঠক সামনে এ আছারের একাধিক উদ্ধৃতি দেখতে পাবেন।
লেখক ‘তাহকীক’ শিরোনামে যতগুলো উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন, তার কোনোটিতেই এ কথা বলা হয়নি যে, আবু হুরায়রা রা.-এর উল্লিখিত বক্তব্যটি জাল, ভিত্তিহীন কিংবা যঈফ। উদ্ধৃতিগুলোতে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে যে, ‘এশার সালাতের ওয়াক্ত সুবহে সাদিক পর্যন্ত থাকে’ এ কথাটি সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস কি না? যাইলাঈ, ইবনে হাজার ও ইবনে হুমাম (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেছেন, এ কথাটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস হিসেবে আমরা পাইনি।
তাহলে মারফ‚ হাদীসটিকেও তারা জাল কিংবা ভিত্তিহীন বলেননি। তবে এটা ঠিক যে, গোলাম কাদের এটিকে ভিত্তিহীন বলে দাবী করেছেন। তিনি একজন সাধারণ আলেম, মুহাদ্দিস নন। তবে আবু হুরায়রা রা.-এর যে আছারটি লেখক উল্লেখ করেছেন, এই মুহাদ্দিসগণ এর উল্লেখই করেননি, ভিত্তিহীন বলা তো দূরের কথা। আর সহীহ বর্ণনাকে তারা কীভাবেই বা ভিত্তিহীন বলবেন?
তো লেখক আখেরাতে এ ভুল ব্যাখ্যার কী জবাব দেবেন?
এরপর লেখক ইমাম তাহাবী রহ. -এর ব্যাপারে যে অপবাদ আরোপ করেছেন, সে জন্য ‘তুহফাতুল আহওয়াযী’র হাওয়ালা দিয়েছেন। অথচ ‘তুহফাতুল আহওয়াযী’ গ্রন্থের প্রণেতা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী রাহ. মিথ্যাবাদীও নন এবং বেয়াদবও নন যে, তিনি ইমাম তাহাবী সম্পর্কে লিখবেন যে, ইমাম তাহাবী মাযহাবী মোহে এর পক্ষে মত দিয়েছেন। ইমাম তাহাবী রাহ. দালীলিক ভিত্তিতেই বলেছেন যে, এশার সালাতের সময় সুবহে সাদিক উদিত হওয়া পর্যন্ত। তাঁর উপস্থাপিত দলীল নিয়ে মুবারকপুরী সাহেব বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং ইমাম তাহাবীর সঙ্গে সহমত পোষণ না করে তিনি তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছেন। ব্যস, এই পর্যন্তই।
‘মাযহাবী মোহে’ কথাটি দ্বারা প্রচ্ছন্নভাবে একটি দাবী করা হল যে, মাযহাবের ভিত্তি কুরআন ও হাদীস নয়, বরং মাযহাব হচ্ছে মাযহাবের ইমামগণের নিজস্ব মত। আর মাযহাব অবলম্বনকারীরা ইমামগণের ঐ নিজস্ব মতের অনুসারী। এটিই বর্তমানকালের লা মাযহাবীদের ধারণা। এটিকে ধারণা না বলে অপপ্রচার বলাই ভালো। কারণ, তারাও জানে যে, কুরআন ও হাদীস গবেষণা করে মুজতাহিদগণ যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন সেটিকেই মাযহাব বলে। যেমন আমীন নিঃশব্দে বলা উত্তম, না সশব্দে বলা উত্তম- এই বিষয়টি নিয়ে যখন মুজতাহিদগণ হাদীসের ভাণ্ডার নিয়ে গবেষণা করেছেন তখন কারও কারও গবেষণা তাঁকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত করেছে যে, আমীন নিঃশব্দে বলা উত্তম। তখন তিনি তদনুসারে আমল করেছেন। ফলে বলা হয়েছে যে, আমীন নিঃশব্দে বলা অমুকের মাযহাব। অর্থাৎ এটি তাঁর দালীলিক বিচার-বিশ্লেষণলব্ধ মত ও সিদ্ধান্ত। তাঁর মনগড়া সিদ্ধান্ত নয়।
মুহতারাম,
আপনি জানেন যে, ইজতিহাদ একটি সুকঠিন বিষয়। ইজতিহাদের জন্য প্রয়োজন হাদীস ও কুরআনসহ শরীয়ত সংশ্লিষ্ট সকল বিষয় মুজতাহিদের সামনে স্পষ্ট থাকা। প্রয়োজন অগাধ পাণ্ডিত্য এবং সেই সঙ্গে আল্লাহ প্রদত্ত ফিক্হ ও অন্যান্য প্রতিভার সঙ্গে সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি। আর এই কারণেই বহু বিখ্যাত সব মুহাদ্দিস নিজেরা ইজতিহাদ করে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার চেয়ে ঐরূপ কোনো মুজতাহিদের ইজতিহাদের উপর নির্ভর করাকেই নিরাপদ মনে করেছেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক, ওয়াকী ইবনুল জাররাহ, ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীনসহ বিখ্যাত ও প্রবাদপুরুষ মুহাদ্দিসগণও ইমাম আবূ হানীফার ইজতিহাদের উপর নির্ভর করেছেন এবং শাখা প্রশাখাগত মাসআলা মাসায়েলে তাঁরা তাঁর অবলম্বিত মত ও পথকে অবলম্বন করেছেন। তদ্রƒপ কেউ ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বলের মত ও পথকে অবলম্বন করেছেন। কেউ ইমাম শাফিঈর মত ও পথকে, কেউ ইমাম মালেকের মত ও পথকে। (রাহিমাহুমুল্লাহ)। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার জায়গা এটা নয়।
আমাদের মূল আলোচনায় ফিরে আসি। এশার সালাতের শেষ ওয়াক্ত সুবহে সাদিক পর্যন্ত থাকে, এ ব্যাপারে যদি শুধু আবু হুরায়রা রাযিআল্লাহু আনহুর উল্লেখিত বাণীই থাকত এবং ত্বহাবী রহ. এর ভিত্তিতে এই মাযহাবকে প্রাধান্য দিতেন তারপরও আপত্তির কোন সুযোগ ছিল না। অথচ ত্বহাবী রাহ. তো আরো দলীল-প্রমাণ উল্লেখ করেছেন। এরপরও তাঁর প্রতি এই অপবাদ! কেন এই মিথ্যাচার?!
লেখক এরপর লিখেছেন : মূলতঃ মধ্য রাত পর্যন্ত এশার ছালাতের সময় থাকে। ফজর পর্যন্ত নয়।
মধ্যরাত পর্যন্ত এশার ছালাতের সময় থাকে- এই কথাটির বরাত তিনি দিয়েছেন মুসলিম শরীফের ১৪১৯ নং হাদীসের। সে সম্পর্কে পরে আলোচনা করব। লেখক এরপর একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন, যে হাদীসটিতে একই কথা বলা হয়েছে যে, এশার সালাত মধ্যরাত পর্যন্ত। কিন্তু লেখক হাদীসটিকে যঈফ বলেছেন এবং ইমাম তিরমিযীর বরাতে ইমাম বুখারী রাহ.-এর মন্তব্য উল্লেখ করেছেন। আসরের সালাতের ওয়াক্ত প্রসঙ্গে হাদীসটি নিয়ে আমি বিস্তারিত আলোচনা করে এসের্ছি। সেই আলোচনার সারসংক্ষেপ হল, ইমাম বুখারী রাহ.সহ একাধিক মুহাদ্দিসের বক্তব্য হল, হাদীসটিকে মারফূরূপে বর্ণনার ক্ষেত্রে মুহাম্মাদ ইব্ন ফুযাইল ভুল করেছেন। প্রকৃতপক্ষে হাদীসটি মুজাহিদের মুরসাল বর্ণনা। মুজাহিদ বলেছেন যে, সাহাবায়ে কেরামের মাঝে এই কথার চর্চা ছিল যে, প্রতিটি সালাতের একটি আউয়াল ওয়াক্ত আছে আর একটি আখের ওয়াক্ত আছে। এরপর তিনি প্রতিটি ওয়াক্তের আউয়াল ও আখের ওয়াক্তের বিবরণ দান করেছেন। আসরের সালাতের আলোচনায় আমি বিস্তারিত আলোচনা করে এসেছি যে, হাদীসটি মারফূ হিসাবে সহীহ না হলেও মুজাহিদের মুরসাল বর্ণনা হিসাবে তা সহীহ এবং দলীল হিসাবে গ্রহণযোগ্য। আসরের ওয়াক্তের আলোচনাটি পুনরায় পাঠ করা যেতে পারে। লেখক শুধু এতটুকু জেনেছেন যে, মুহাম্মাদ ইব্ন ফুযাইল হাদীসটি বর্ণনা করতে গিয়ে ভুল করেছেন। কিন্তু ভুলটা কী তা লেখক জানার চেষ্টা করেননি বা জানার চেষ্টা করেও জানতে পারেননি বা সূক্ষ্ম বিষয়টি বুঝতে তাঁর মেধা ব্যর্থ হয়েছে।
যা হোক, একটি কথা না বললেই নয়। সেটি হল, লেখকের দাবী হল, এশার সালাতের ওয়াক্ত মধ্যরাত পর্যন্ত থাকে। মুহাম্মাদ ইব্ন ফুযাইলের হাদীসেও একই কথা বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু লেখক এটিকে উদ্ধৃত করে বলেছেন যে, হাদীসটি যঈফ। তদ্রƒপ মাগরিবের ওয়াক্ত সম্পর্কে লেখক যেই মত পোষণ করেন সেই মত সমর্থনকারী কিছু ভিত্তিহীন ও যঈফ হাদীসও তিনি উদ্ধৃত করেছেন। আউয়াল ওয়াক্তে সালাত আদায় করাকে লেখক মুস্তাহাব বলে দাবি করছেন। আবার আউয়াল ওয়াক্তে সালাত আদায় মুস্তাহাব সম্পর্কে বেশ কিছু ভিত্তিহীন হাদীসও তিনি উল্লেখ করেছেন। তাহলে তাঁর এই সব মত কি জাল হাদীস দ্বারা আক্রান্ত? ঐসব ভিত্তিহীন জাল ও যঈফ হাদীসের কারণে তাঁর সালাত কি জাল হাদীসের কবলে আবদ্ধ? লেখক নিশ্চয়ই বলবেন যে, না আমাদের সালাত জাল হাদীস দ্বারা আক্রান্ত নয়। আমাদের সালাত জাল হাদীসের কবলে পড়েনি। কারণ, আমাদের ঐসব মতের পক্ষে সহীহ হাদীস বিদ্যমান। তা-ই যদি হয়ে থাকে তাহলে লেখক এ দেশের মানুষের সালাতকে জাল হাদীসের কবলে আখ্যায়িত করলেন কেন? এ দেশের মানুষ যে পদ্ধতিতে সালাত আদায় করে থাকে সেই পদ্ধতির পক্ষেও তো সহীহ হাদীস বিদ্যমান। তাঁদের সালাতের কোনো একটি বিষয়ও এমন নাই যার ভিত্তি শুধুই জাল হাদীস। লেখক এরূপ একটি মাসআলা উপস্থাপন করুন যে মাসআলার পক্ষে কোনো সহীহ দলীল নেই, শুধুই ভিত্তিহীন হাদীস রয়েছে।
এশার ছালাতের সঠিক সময়
এই শিরোনামে লেখক লিখেছেন, মাগরিবের ছালাতের সময়ের পর থেকে এশার ওয়াক্ত শুরু হয় এবং মধ্যরাত পর্যন্ত থাকে। সমস্যাজনিত কারণে ফজরের পূর্ব পর্যন্ত পড়া যাবে। তবে রাসূল (ছাঃ) এশার ছালাত দেরী করে পড়াকে উত্তম মনে করতেন তাই মাগরিবের পরপরই এশার ছালাত পড়া উচিত নয়, যা এ দেশে চালু আছে।
এতে চারটি দাবী করা হয়েছে।
এক : এশার সালাতের ওয়াক্ত মধ্যরাত পর্যন্ত থাকে।
দুই : এশার সালাত সমস্যাজনিত কারণে ফজরের পূর্ব পর্যন্ত পড়া যাবে।
তিন : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এশার সালাত দেরী করে পড়াকে উত্তম মনে করতেন।
চার : এ দেশে মাগরিবের পরপরই এশার সালাত পড়ার রীতি চালু আছে
মন্তব্য ও পর্যালোচনা
প্রথম ও দ্বিতীয় দাবীর মধ্যে স্ববিরোধিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কারণ, ফজরের পূর্ব পর্যন্ত পড়া যাবে কথাটি দ্বারা বোঝা যায় যে, এশার সালাতের ওয়াক্ত ফজর পর্যন্ত বহাল থাকে। মধ্যরাত পর্যন্ত নয়। লেখক যদি বলেন যে, যেহেতু মধ্যরাত পর্যন্ত এশার ওয়াক্ত থাকে ফজর পর্যন্ত নয় সেই কারণেই তো আমি ‘মধ্যরাত পর্যন্ত থাকে’ কথাটির সঙ্গে ‘সমস্যাজনিত কারণে’ শর্তটি যুক্ত করিনি। ফজরের পূর্ব পর্যন্ত পড়া যাবে কথাটির সঙ্গে ঐ শর্তটি যুক্ত করেছি। কারণ, ফজরের পূর্ব পর্যন্ত ওয়াক্ত থাকে না। লেখকের বিরুদ্ধে তখন প্রশ্ন দাঁড়াবে যে, তাহলে ‘সমস্যাজনিত কারণে পড়া যাবে’ কথাটিকে ফজরের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের সঙ্গে সীমাবদ্ধ করে দিলেন কেন? সমস্যাজনিত কারণে কেউ যদি ফজরের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যেও সালাত আদায় করতে না পারে তাহলে কি সে ফজরের ওয়াক্ত চলে আসলে আর এশার সালাত আদায় করতে পারবে না বা আদায় করবে না? সহীহ হাদীস তো এ কথা বলে যে, নিদ্রার কারণে বা ভুলে যাওয়ার কারণে কেউ যদি ওয়াক্তের মধ্যে সালাত আদায় করতে না পারে তাহলে যখন সে জাগ্রত হবে বা তার স্মরণ হবে তখনই সে সালাত আদায় করবে। ঐ হাদীস অনুযায়ী সমস্যাজনিত কারণে তো ফজরের পরেও এশার সালাত আদায় করতে পারবে এবং আদায় করবে। তাহলে ‘ফজরের পূর্ব পর্যন্ত’ শর্তটি কেন জুড়ে দিলেন? এ কথা কেন লিখলেন না যে, সমস্যাজনিত কারণে পরের দিন যোহর পর্যন্ত আদায় করা যাবে বা পরের দিন মাগরিবের পূর্ব পযন্ত আদায় করা যাবে বরং জীবনের যে কোনো দিন যে কোনো সময়ে আদায় করা যাবে? ‘সমস্যাজনিত কারণে’ কথাটির সঙ্গে লেখকের বিশেষ এক প্রেম রয়েছে বলে অনুমিত হয়। কারণ, তিনি না বুঝেই ফজর এবং আসরের ওয়াক্তের আলোচনাতেও এই একই কথা বলেছেন। ঐ দুই জায়গাতেও আমি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি এবং লেখকের ভ্রান্তি তুলে ধরেছি। আসলে ‘সমস্যাজনিত কারণে পড়া যাবে’ কথাটির মর্ম কী তা হয়তো লেখক জানেন না ও বোঝেনই না। অথবা তিনি জেনে শুনেও শুধু মাযহাবের বিরোধিতার উদ্দেশ্যে এবং নিজ মতের পক্ষে হঠকারিতা ও গোঁড়ামিবশত স্পষ্টভাষায় স্বীকার করতে চান না যে, আসরের ওয়াক্ত সূর্যাস্ত পর্যন্ত থাকে এবং এশার ওয়াক্ত ফজরের পূর্ব পর্যন্ত থাকে। কোনো ইমামের মাযহাব ও মতের পক্ষাবলম্বনে গোঁড়ামি নিন্দনীয় আর লেখকের নিজের মতের পক্ষাবলম্বনে তাঁর গোঁড়ামি প্রশংসনীয়? লেখক স্পষ্টভাষায় স্বীকার না করলেও প্রকারান্তরে কিন্তু স্বীকার করে নিয়েছেন যে, আসরের ওয়াক্ত সূর্যাস্ত পর্যন্ত এবং এশার ওয়াক্ত ফজরের পূর্ব পর্যন্ত থাকে। সুতরাং ফজরের পূর্ব পর্যন্ত এশার ওয়াক্ত থাকার পক্ষে দলীল কী তা নিয়ে আমার আর আলোচনার প্রয়োজন থাকে না। তবে বিষয়টি আরও স্পষ্ট করার জন্য একটু আলোচনা করা যেতে পারে।
দেখুন, লেখক মুসলিম শরীফের যে হাদীসের প্রেক্ষিতে দাবী করেছেন যে, এশার সালাতের ওয়াক্ত মধ্যরাত পর্যন্ত থাকে, ফজরের পূর্ব পর্যন্ত নয় সেই হাদীসের তিনটি হাদীস পূর্বে ১৪১৬ নং হাদীসের আলোচনায় মুসলিম শরীফের প্রখ্যাত ভাষ্যকার আল্লামা ইমাম নববী রাহ. হাদীসের فإنه وقت إلى نصف الليل (তো এটা এশার ওয়াক্ত, মধ্যরাত পর্যন্ত)-এই অংশের ব্যাখ্যায় লিখেছেন,
معناه وقت لأدائها اختيارا أما وقت الجواز فيمتد إلى طلوع الفجر الثاني لحديث أبي قتادة الذي ذكره مسلم بعد هذا في باب من نسي صلاة أو نام عنها إنه ليس في النوم تفريط إنما التفريط على من لم يصل حتى يجيء وقت الصلاة الأخرى وسنوضح شرحه في موضعه إن شاء الله.
অর্থাৎ, এটা এশার পছন্দনীয় ওয়াক্ত। বাকী রইল বৈধ ওয়াক্ত। তো তা ফজর পর্যন্ত প্রলম্বিত। আবূ কাতাদাহ্র ঐ হাদীসের কারণে, ইমাম মুসলিম যেটাকে পরে উল্লেখ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি সালাতের কথা ভুলে গেল বা সালাত আদায় না করে ঘুমিয়ে পড়ল’ এই অধ্যায়ে। হাদীসটি হল, নিদ্রায় কোনো ত্রুটি নাই। ত্রুটি হল, ঐ ব্যক্তির যে সালাত আদায় করল না অন্য আরেকটি সালাতের ওয়াক্ত আসা পর্যন্ত। যথাশীঘ্রই হাদীসটির মর্ম যথাস্থানে স্পষ্ট করব ইনশাআল্লাহ।
ইমাম নববী রাহ. বলতে চাচ্ছেন যে, এই হাদীসে যে মধ্যরাত পর্যন্ত এশার সালাতের কথা বলা হয়েছে তার দ্বারা এই কথা বোঝানো উদ্দেশ্য যে, মধ্যরাত পর্যন্ত ওয়াক্তটি এশার সালাতের জন্য পছন্দনীয় ওয়াক্ত। এই ওয়াক্তের মধ্যেই এশার সালাত আদায় করা উচিত। তবে বৈধ ওয়াক্ত আরও দীর্ঘ। আর তা সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। অতএব মধ্যরাতের পরে সালাত আদায় করলেও ব্যক্তির সালাত আদায় হয়ে গেছে বলা হবে। বলা হবে না যে, তার সালাত কাযা হয়ে গেছে। কারণ সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এশার সালাত আদায় করা বৈধ। তাঁর এই দাবীর পক্ষে দলীল হিসাবে তিনি আবূ কাতাদাহ রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়েছেন যেটি মুসলিম শরীফেই বিদ্যমান রয়েছে এবং সেই হাদীসটির পূর্ণ ব্যাখ্যা কী তা তিনি সেখানেই উল্লেখ করবেন বলে ওয়াদা করেছেন। হাদীসটি মুসলিম শরীফের ১৫৯৪ নং হাদীস। যা উপমহাদেশীয় ছাপা কিতাবের ২৩৯ নং পৃষ্ঠায় সন্নিবেশিত হয়েছে। হাদীসটি এই:
ليس في النوم تفريط إنما التفريط على من لم يصل حتى يجيء وقت الصلاة الأخرى
‘নিদ্রায় কোনো ত্রুটি নেই। ত্রুটি ঐ ব্যক্তির যে আরেকটি সালাতের ওয়াক্ত আসার পূর্ব পর্যন্তও সালাত আদায় করেনি।’
এই হাদীসের আলোচনায় ইমাম নববী রাহ. বলেন,
فى الحديث دليل على إمتداد وقت كل صلاة من الخمس حتى يدخل وقت الأخرى وهذا مستمر على عمومه في الصلوات كلها إلا الصبح فإنها لاتمتد إلى الظهر بل يخرج وقتها بطلوع الشمس لمفهوم قوله صلى الله عليه وسلم من أدرك ركعة من الصبح قبل أن تطلع الشمس فقد أدرك الصبح وأما المغرب ففيه خلاف سبق بيانه فى بابه والصحيح المختار امتداد وقتها إلى دخول وقت العشاء للأحاديث الصحيحة السابقة في صحيح مسلم وقد ذكرنا الجواب عن حديث إمامة جبريل صلى الله عليه وسلم في اليومين في المغرب في وقت واحد.
وقال أبو سعيد الإصطخري من أصحابنا: تفوت العصر بمصير ظل الشيء مثليه وتفوت العشاء بذهاب ثلث الليل أو نصفه وتفوت الصبح بالإسفار وهذا القول ضعيف والصحيح المشهور ما قدمناه من الامتداد إلى دخول الصلوة الثانية.
অর্থ: ‘এই হাদীসে এই কথার পক্ষে দলীল রয়েছে যে, পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের প্রতিটির ওয়াক্ত প্রলম্বিত হয় যতক্ষণ না অপর সালাতের ওয়াক্ত আসে। আর এটা তার ব্যাপকতার কারণে প্রতিটি সালাতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ফজর ব্যতীত। কেননা ফজরের ওয়াক্ত যোহর পর্যন্ত প্রলম্বিত হয় না। বরং ফজরের ওয়াক্ত সূর্যোদয়ের সাথে সাথে শেষ হয়ে যায়। আর এর কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই উক্তি-‘যে ব্যক্তি সূর্যোদয়ের পূর্বে ফজরের এক রাকআত পেল সে ফজর পেল।’ আর মাগরিবের ব্যাপারে মতভেদ আছে। মাগরিবের আলোচনায় মতভেদটির বিবরণ গত হয়েছে। সহীহ ও গ্রহণযোগ্য মত হল, মাগরিবের সালাতের ওয়াক্তও এশার ওয়াক্ত আসা পর্যন্ত প্রলম্বিত হয়। আর তা ঐ সকল সহীহ হাদীসের কারণে, মুসলিম শরীফে যা পূর্বে বিবৃত হয়েছে। আর হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম কর্তৃক দুইদিন একই সময়ে মাগরিবের সালাত আদায় করণের কারণ কী, পূর্বেই আমি তার জবাব দিয়ে এসেছি। আমাদের একজন আলেম আবূ সাঈদ আল-ইসত্খরী বলেন, আসরের সালাত ফউত হয়ে যাবে বস্তুর ছায়া তার দ্বিগুণ হলে। এশার সালাত ফউত হয়ে যাবে রাতের এক তৃতীয়াংশ বা অর্ধেক অতিক্রান্ত হলেই এবং ফজরের সালাত ফউত হয়ে যাবে পূর্বাকাশ ফর্সা হয়ে গেলেই। এই মতটি যইফ। সহীহ ও প্রসিদ্ধ মত তা-ই যা আমি বর্ণনা করে এসেছি। আর তা হল, এক সালাতের ওয়াক্ত প্রলম্বিত হয় অপর সালাতের ওয়াক্ত আসার পূর্ব পর্যন্ত।’
মুহতারাম,
আপনার সামনে নিশ্চয়ই স্পষ্ট হয়েছে যে, সহীহ হাদীস আমাদেরকে জানান দেয় যে, এশার সালাতের ওয়াক্ত ফজরের পূর্ব পর্যন্ত বহাল থাকে। সমস্যাজনিত কারণে ফজরের পূর্ব পর্যন্ত আদায় করা যাবে- এই কথা বলে লেখক প্রকারান্তরে তা স্বীকারও করে নিয়েছেন। ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহর উপরিউক্ত বক্তব্যটি পাঠ করার পর আমার সামনে নতুন একটি বিষয় খোলাসা হয়েছে। আর তা হল, আমাদের আলোচ্য লেখক মূলত আবূ সাঈদ আল ইসতাখরীর এই যঈফ ও শায বা উম্মাহ-বিচিছন্ন মতটিকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু আবূ সাঈদ আল ইসতাখরীর মতকে পুরোপুরি গ্রহণ করতে সাহস পাননি উম্মাহ-বিচ্ছিন্ন মত হওয়ার কারণে। ফলে তিনি প্রতিটি জায়গাতেই আবার বলেছেন, তবে সমস্যাজনিত কারণে অমুক সময় পর্যন্ত আদায় করা যাবে। আর এরই ফলে তাঁর বক্তব্য হয়ে গেছে স্ববিরোধী।
ইমাম নববী রাহ. কর্তৃক পেশকৃত আবূ কাতাদাহ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু-এর হাদীস ছাড়াও হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন আব্বাস রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু এবং হযরত আবূ হুরায়রা রা.-এর উক্তি প্রমাণ করে যে, এশার সালাতের ওয়াক্ত ফজর তথা সুবহে সাদিক উদিত হওয়া পর্যন্ত থাকে। ইব্ন আব্বাস রা.-এর আছর বা উক্তিটি বর্ণিত হয়েছে এই সনদে, এইভাবে:
حدثنا إسحاق عن عبد الرزاق عن معمر عن الثوري عن ليث عن طاووس عن ابن عباس قال: وقت المغرب إلى العشاء ووقت العشاء إلى الفجر.
ইব্ন আব্বাস রা. বলেন, মাগরিবের ওয়াক্ত এশা পর্যন্ত এবং এশার ওয়াক্ত ফজর পর্যন্ত।
এই একই সনদে ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. তাঁর ‘কিতাবুল হুজ্জাহ আ’লা আহলিল মাদীনাহ’ গ্রন্থে ইব্ন আব্বাস রা-এর উক্তিটি বর্ণনা করেছেন এইভাবে :
أخبرنا سفيان الثوري قال حدثنا ليث بن ابي سليم عن طاووس عن ابن عباس قال: وقت الظهر إلى العصر، ووقت العصر إلى المغرب، ووقت المغرب إلى العشاء، ووقت العشاء إلى الفجر.
অর্থ: ইব্ন আব্বাস রা. বলেন, যোহরের ওয়াক্ত আসর পর্যন্ত, আসরের ওয়াক্ত মাগরিব পর্যন্ত, মাগরিবের ওয়াক্ত এশা পর্যন্ত এবং এশার ওয়াক্ত ফজর পর্যন্ত।
হযরত আবূ হুরায়রা রা.-এর উক্তিটি বর্ণিত হয়েছে এই সনদে এইভাবে:
حدثنا إسحاق عن عبد الرزاق عن الثوري عن عثمان بن موهب قال: سمعت أبا هريرة وسأله رجل عن التفريط في الصلاة، فقال: أن تؤخروها إلى وقت التي بعدها، فمن فعل ذلك فقد فرط.
অর্থ: উসমান ইব্ন মাওহিব বলেন, আবূ হুরায়রা রা.-কে এক ব্যক্তি সালাতে চরম ত্রুটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে উত্তরে তাঁকে আমি বলতে শুনেছি, ‘চরম ত্রুটি হল, সালাতকে তার পরবর্তী সালাতের ওয়াক্ত আসা পর্যন্ত বিলম্বিত করা। যে ব্যক্তি এরূপ করল সে চরম ত্রুটি করল।
হযরত আবূ হুরায়রা রা.-এর উক্তিটি হযরত আবূ কাতাদাহ রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের মর্মকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। এছাড়া শরহু মা’আনিল আছারে (ত্বাহাবী শরীফে) আবূ হুরায়রা রা.-এর উক্তিটি আরও স্পষ্ট শব্দে ব্যক্ত করে যে, এশার সালাতের ওয়াক্ত ফজর পর্যন্ত। ইমাম ত্বাহাবী বলেন,
حدثنا يونس قال ثنا عبد الله بن يوسف قال ثنا الليث ح وحدثنا ربيع المؤذن قال ثنا شعيب بن الليث قال ثنا الليث عن يزيد بن أبي حبيب عن عبيد بن جريج أنه قال لأبي هريرة: ما إفراط صلاة العشاء قال: طلوع الفجر.
অর্থাৎ ইব্ন জুরাইজ আবূ হুরায়রা রা.-কে জিজ্ঞাসা করলেন, এশার সালাতে কোন কর্মটি চরম ত্রুটি? হযরত আবূ হুরায়রা রা. বললেন, ফজর উদিত হওয়া।
অর্থাৎ ফজর উদিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্তও যদি কেউ এশার সালাত আদায় না করে তাহলে তার এই কর্মটি চরম ত্রুটি হিসাবে পরিগণিত হবে। কারণ, তখন এশার সালাত কাযা হয়ে যাবে। বুঝা গেল যে, ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত এশার সালাতের ওয়াক্ত থাকে। এই বিষয়টিও প্রণিধানযোগ্য যে, ওয়াক্তের বিষয়টি ‘মুদরাক বিল কিয়াস’ নয়; যুক্তি ও বুদ্ধি দ্বারা অবগত হওয়ার মত বিষয় এটি নয়। সুতরাং হযরত ইব্ন আব্বাস রা. ও হযরত আবূ হুরায়রা রা. বিষয়টি নিশ্চয়ই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেই জেনেছেন। অতএব তাঁদের বক্তব্যটি মারফূয়ে হুকমী বা পরোক্ষ মারফূ হাদীস হিসাবে বিবেচিত হবে।
হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. তাঁর খেলাফতকালে হযরত আবূ মূসা আশআরী রা.-এর উদ্দেশে একটি পত্রে লিখেছিলেন। এক বর্ণনা অনুযায়ী এই পত্রের সংশ্লিষ্ট অংশের পাঠ নিম্নরূপ:
وَصَلِّ الْعِشَاءَ أَيَّ اللَّيْلِ شِئْتَ وَلَاتُغْفِلْها
‘এবং এশার সালাত আদায় করবে রাতের যে কোনো অংশে তুমি আদায় করতে চাও, তবে এশার সালাতকে তোমার অবহেলার শিকার বানাবে না।’
হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর أَيَّ اللَّيْلِ شِئْتَ কথাটি স্পষ্টরূপেই ব্যক্ত করে সমস্ত রাত-ই এশার সালাতের ওয়াক্ত।
মুহতারাম,
সন্দেহ নেই যে, ফুকাহায়ে কেরামের অনেকেই বলেছেন যে, এশার সালাতের ওয়াক্ত মধ্যরাত পর্যন্ত। কিন্তু তাঁদের এই কথার অর্থ এই নয় যে, মধ্যরাতের পরে এশার ওয়াক্ত থাকে না। বরং তাঁরা বলতে চেয়েছেন যে, এশার সালাতের মাকরূহবিহীন বা দোষবিহীন ওয়াক্ত হল মধ্যরাত পর্যন্ত। বিনা ওযরে মধ্যরাতের পরে এশার সালাত আদায় করা মাকরূহ এবং গুরুতর অন্যায়। তবে বিনা ওযরে মধ্যরাতের পরে এশার সালাত আদায় করা অন্যায় হলেও তার সালাত ‘আদা’ হিসাবেই গণ্য হবে, ‘কাযা’হিসাবে নয়। কারণ এশার সালাতের ওয়াক্ত ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত বহাল থাকে। আর এই কারণেই ফুকাহায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত যে, কোনো ব্যক্তি যদি মধ্যরাতের পরে ইসলাম গ্রহণ করে বা কোনো বালক যদি মধ্যরাতের পরে বালেগ হয় বা কোন ঋতুবতী নারীর ঋতু যদি মধ্যরাতের পরে বন্ধ হয়ে যায় তবে তাদের উপর এশার সালাত আদায় করা ফরয হয়ে যাবে। যদি ফজর পর্যন্ত এশার সালাতের ওয়াক্ত বহাল না থাকত তাহলে এশার সালাত আদায় করা এদের উপর ফরয হত না। ঠিক আমরাও তা-ই বলি। আমরা বলি যে, এশার সালাত আদায় করতে হবে মধ্যরাতের পূর্বেই। বিনা ওযরে মধ্যরাতের পর পর্যন্ত এশার সালাত বিলম্বিত করা মাকরূহ ও গুনাহের কারণ। কিন্তু কেউ যদি তা করে তবে বলব না যে, তার সালাত কাযা হয়ে গেছে। কারণ, এশার সালাতের ওয়াক্ত থাকে সুবহে সাদিক উদিত হওয়া পর্যন্ত। জনাব মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবও বলেছেন যে, এশার সালাত সমস্যাজনিত কারণে ফজরের পূর্ব পর্যন্ত পড়া যাবে। আমরাও তা-ই বলি। তাহলে বিরোধ কোথায়? হাঁ বিরোধ এতটুকু যে, তাঁর বক্তব্য ও মতের মধ্যে রয়েছে স্ববিরোধিতা । আমাদের বক্তব্য ও মতের মধ্যে তা নেই, আছে সংগতি ও পরিপূর্ণ ভারসাম্য।
মুহতারাম,
এরপর দেখুন যে, তিনি লিখেছেন, তাই মাগরিবের পরপরই এশার সালাত পড়া উচিত নয় যা এ দেশে চালু আছে। এবার বলুন, লেখককে আপনি কী অভিধায় অভিহিত করবেন? বিকৃত মস্তিষ্ক, না দুগ্ধপোষ্য অবোধ শিশু? মাগরিবের পরপরই এ দেশের কোন্ মসজিদে এশার সালাত আদায় করা হয়? মাগরিবের পর এক ঘন্টা আঠারো মিনিট পরে সাধারণত শাফাক অদৃশ্য হয়। এরপর এ দেশে আযান দেওয়া হয় এবং আযানের আধা ঘন্টা পরে এশার সালাত আদায় করা হয়। আজ (২১ নভেম্বর) মাগরিবের আযান হবে পাঁচটা পনের মিনিটে এবং আযানের পরপরই মাগরিবের জামাত অনুষ্ঠিত হবে। আর শাফাক অদৃশ্য হবে তথা এশার সালাতের ওয়াক্ত হবে ছয়টা একত্রিশ মিনিটে। কোনো কোনো মসজিদে সাতটায় আযান হবে এবং সাড়ে সাতটায় জামাত হবে; কোনো কোনো মসজিদে আরও পরে আযান হবে এবং জামাত হবে। এরই নাম কি মাগরিবের পরপর?
আজকে এ পর্যন্তই। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। দুআ চাই। দুআ করি, আপনি ভালো থাকুন।
মাআসসালাম।
বিনীত আব্দুল গাফ্ফার, শহীদবাগ জামে মসজিদ।
২১ নভেম্বর, ২০১৪; ২৭ মুর্হারম, ১৪৩৬।
Source: মাসিক আলকাউসার
Leave a Reply